ব্রেইলে লেখা বাক্যগুলি
জয়িত্রী সাংবাদিকতা পড়ছে। জয়িত্রী সেযান শহরে মার্কো পোলোর গাইড। শহরের মেয়র তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। জয়িত্রীর লাভ হয়েছে কম না। হাজার হাজার মাইল ঘুরে আসা ভেনিসীয় পর্যটক মার্কোর কাছে যে খবর পেয়ে যাচ্ছে, তা সে পাবে কোথায়? মেয়রের কথায় জয়িত্রী সব নোট রাখছে। সেযান টাইমস পত্রিকায় লিখবে গুছিয়ে নিয়ে। মেয়র তা বলেছেন। সেযান শহরের মানুষ জেনে নিক পৃথিবীর খবর, অদৃশ্য এক ঘাতক কীভাবে সব স্তব্ধ করে দিয়েছে। খবর দিচ্ছে খবরিয়া মার্কো পোলো যে কিনা লকডাউনের সময় ভেনিসের পথে যাত্রা করে ভেনিস ভেবে এই শহরে এসে পৌঁছেছে। মার্কো ভেনিস ভুলে গেছে। ১৭ বছর বয়সে ভেনিস থেকে বাবা নিকোলো পোলো এবং কাকা মেফিও পোলোর সঙ্গে সেই যে বেরিয়েছিল কনস্টান্টিনোপল জেরুজালেম আর্মেনিয়া, জর্জিয়া হয়ে এশিয়ার পথে, তারপর কী হলো মার্কোর মনে নেই। ১২৯৫-এ ২৪ বছর বাদে ভেনিসে ফিরেছিল যখন নিকোলো পোলো, মার্কোও ফিরেছিল তো। ফিরেছিল না ফিরছে সে। ক্রমাগত ফিরেই চলেছে নিজের শহরে অথবা এমন এক শহরে, পৃথিবীর মানুষ বলে তা মার্কোর শহর। মার্কো বলে, ঢাকাও তার শহর, কলকাতাও তার শহর, নিউইয়র্ক, সিডনি, লন্ডন, মাদ্রিদ, ভেনিস, মিলান… তারই শহর। লকডাউনের সময় পরবাসীরা নিজ গৃহে ফিরবে, তাই মার্কোও ফিরছে। দিল্লি, অমৃতসর, লাহোর, করাচি, কাবুল, সমরখন্দ, আস্তানা…। মার্কো জিজ্ঞেস করল, অ্যালেক্স সাড়া দিল?
কবে ফিরতে পারবে জানি না, একা একটা ঘরে বসে আছে, আচমকা বন্ধ হয়ে গেল যাওয়া আসা। জয়িত্রী বিষণ্ণ মুখে কথাটি বলল, লকডাউন কবে শেষ হবে মার্কো?
মহামারী চলতে থাকবে, তারই ভিতর মানুষের বেঁচেও থাকবে।
গাল ভর্তি দাড়ি, কী অন্ধকার মুখ, ওর শহরের নাম ভ্যাস্তেরস, সুইডেনের রাজধানী স্টকহলম থেকে ১০০ কিমি দূরে। কদিন আগেও সেখানে তুষারপাত হয়েছে। ছোট শহর। দেড় লক্ষর মতো মানুষের বাস। সে একটা বাঙলোয় একা, বাড়িগুলো ছাড়া ছাড়া, একটা থেকে আর একটার দূরত্ব আছে, কথা হয় না, মানুষের মুখ দেখা যায় না, দূরে এক বৃদ্ধা থাকেন, তাঁরা হাত নাড়েন, কী রকম একা, উফ!
মার্কো বলল, পৃথিবী এক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, মন শান্ত করো, শোনো, অন্য কথা বলি, ঢাকাই কুট্টির রসিকতা, শহরের এক বাবু, চোগা চাপকান, সুরমায় সুশোভিত, সে চায়ের পেয়ালা নিয়ে আয়েশ করে বসেছে চা-কফিখানায়, চা এসেছে সুদৃশ পেয়ালা ভরে, সে দেখল চায়ে ভাসছে এক মরা মাছি, সে চিৎকার করে ডাকল ওয়েটারকে, মাছি কেন চায়ের ভিতর?
ওয়েটার হেসে বলল, পাঁচ টাকার চায়, মাছি পড়ব না তো কি এরোপ্লেন পড়ব?
এই কথা কেন? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করল।
মন খারাপ থেকে বের করে আনতে বললাম, ঢাকা অনেক পুরান শহর, ঢাকার মানুষ রসিক, ঢাকায় শুনেছি ৭০০ মসজিদ আছে, হাজার হাজার রিকশা চলে, বাবুরা রিকশায় হাওয়া খেতে খেতে বাড়ি ফেরেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশা চাপেন। আগে ছিল ফিটন, তার সঙ্গে জোড়া দুবলা ঘোড়া, এখন তার বদলে রিকশা, কিন্তু নামী দামী গাড়িও কম না, অবশ্য তাদের আগে রিকশা ছোটে, বাসও আছে, ডবল ডেকার, প্যাসেঞ্জাররা বাসে উঠেই কন্ডাকটরকে বিঁধতে আরম্ভ করে, ভাগ্না, গাড়োয়ানকে বলো নিচে নেমে ঠেলতে, গাড়ি আর যায়ই না। কন্ডাক্টর উত্তর দেয়, আরে মামা বস, যে টেকা ভাড়া দিছ, তার চেয়ে বেশি টায়েম ফ্রি দিচ্ছি, এক ভাড়ায় ডবল যাচ্ছ…।
ঢাকার বয়স ৪০০ বছর হবে, পুরোন নাম জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকার মসলিন নিতে একসময় দূর-দূরান্ত থেকে বণিকেরা আসত। ঢাকাই জামদানির সুখ্যাতি পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু এখন সব বন্ধ। গারমেন্টস ফ্যাক্টরির কর্মীরা বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার এসেছে ফিরে। কাজ ছাড়া অন্ন নেই। ভাইরাস আসে আসুক। কত মারবি মার। ঢাকার শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছিলাম ২১শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে, শোনো বাংলাদেশে ভাষার জন্য কী হয়েছিল।
জয়িত্রী জানে। তখন মার্কো ঢাকার মানুষের কথা বলতে লাগলেন। কী শুনেছেন কী দেখেছেন মার্কো তা। ঢাকা শহরের প্রান্তেও এক নদী আছে, বুড়িগঙ্গা। ঢাকার এক পুরোন শহর আছে, নতুন শহর আছে। নতুন শহরে আকাশচুম্বী বাড়ি দেখতে দেখতে রিকশায় করে পুরান শহরের হাভেলিতে পৌঁছে যেতে পার। মহামারীর কারণে দুই ঢাকাতেই ছুটি চলছে। সব বন্ধ। কোভিড-১৯ এসে গেছে উড়ানে উড়ানে। নিমোনিয়া হয়ে মানুষ মরছে। মরছে আবার বেঁচেও যাচ্ছে।
৩০.০৩ তারিখে ঢাকার এক রাগী কন্যা জান্নাতুম নয়িম প্রীতি লিখল
“আমি কেয়ামতে বিশ্বাস করিনা, কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধে বিশ্বাস করি। আমরা সচেতন মানুষরা আশংকা করছিলাম একসময় এন্টিবায়োটিক ওষুধে আর কাজ হবেনা, মুড়ির মতো করে এন্টিবায়োটিক লেখা আমাদের ডাক্তাররা থামান নাই। এখন সেইসব ওষুধ খেয়ে রেজিটেন্স পাওয়ার কমানোর পরে আরও শক্তিশালী একটা ফ্লু অর্থাৎ করোনা যখন এল, তখন আমরা হা করে আছি আর হাজারে হাজারে মারা যাচ্ছি। গত বছর গ্রেটা থানবার্গ যখন বিশ্বনেতাদের বারবার করে দুনিয়ার তাপমাত্রা কমাতে বলল – নোবেল প্রাইজ কমিটিও তারে পাত্তা দিলো না, নোবেল পাইলেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলি। অথচ আনবিক যুদ্ধ থামানোর চেয়েও, স্পেস শাটল বানানোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাপমাত্রা কমানো।
টাইম ম্যাগাজিনের কয়দিন আগেই ইউভাল নোয়া হারারি লিখেছেন – দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংকট মহামারী না, সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে – দুনিয়ার একজন নেতা না থাকা!
দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি বলেছেন গতকাল জানেন? করোনায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি রাখতে পারাই হবে তার কৃতিত্ব!
অথচ সিরিয়ায় শিশুদের ওপর বোমা ফেলা, প্যালেস্টাইনের ওপর ইজরায়েলের আধিপত্য বিস্তার থেকে সৌদি আরবের সাথে জোট বেঁধে কি পরিমাণ টাকা খরচ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প? বিগত ইরাক যুদ্ধেই বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতো খরচ ছিল?
চীন উইঘুরদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানাতে যে পরিমাণ ব্যয় করেছে, করোনার জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার নিউজ রুখতে কী পরিমাণ ব্যয় করেছে?
লকডাউন দেয়ার কারণ এইটা না যে আপনি লকডাউন দিয়ে ভাইরাস সংক্রমণ আজীবনের জন্য ঠেকাবেন। লকডাউনের কারণ এইটা যে সংক্রমণটা ধীর করে দেয়া। … কারণ দুনিয়ায় যে পরিমাণ রোগী এইমুহূর্তে করোনা ভাইরাসের সাথে ফাইট করছেন তাদের অর্ধেকের বেশিকে মেডিক্যাল সাপোর্ট দেয়ার ক্ষমতা দুনিয়ায় কোনো রাষ্ট্রেরই নাই। যেটা আছে সেইটা হচ্ছে নাগরিকদের কাছে ক্ষমা চাওয়া আর মেডিকেল সাপোর্ট বানানো। ভ্যাক্সিন বানানো। গবেষণায় টাকা ঢালা।
১৪ শতাব্দীতে ব্ল্যাক ডেথ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, পাশাপাশি চিকেন পক্স, প্লেগ, সার্স, ইয়েলো ফিভার প্রতিটি মহামারীর ইতিহাস এবং গতিপ্রকৃতির একটা রেখা আছে। সারা দুনিয়ার তথ্যভাণ্ডার বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন। ইতিহাস শিক্ষা দেয় মহামারীর ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য বিনিময় না থাকলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। চীন যদি এই তথ্যগুলো আরও আগে দিতো তাহলে দুনিয়ার প্রতিরোধ ব্যবস্থা এইরকম হইতো না।
রিচার্ড প্রেস্টনের ‘ক্রাইসিস ইন দ্যা রেড জোন’ বইতে ইবোলার সংক্রামণ সংক্রান্ত নানান তথ্য আছে, ইবোলা বাদুড় থেকে হইলেও মানবদেহে জেনেটিক রিকম্বিনেশন ঘটায়, ফলে এই মিউটেশানের কারণে আফ্রিকায় মহামারী ছড়িয়ে পড়লেও আফ্রিকান সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তথ্য দিয়েছিল বলেই আমরা সেই আকারের মহামারীর পাল্লায় পড়িনি। এখন আপনি যখন এই লেখা পড়ছেন তখনো করোনা নামক ভাইরাসটি মিউটেশান ঘটাচ্ছে!…
নেটিভ আমেরিকান একটা প্রবাদ আছে – যখন শেষ গাছটি কেটে ফেলা হবে, শেষ মাছটি খেয়ে ফেলা হবে, শেষ জলাধারটি বিষাক্ত হবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে টাকা খাওয়া যায়না…।
প্রিয় মানুষ, আপনি বুঝতে শিখুন যে প্রকৃতি নিজের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিতে জানে। আর কতোবার সে প্রতিশোধ নিলে আপনি বুঝবেন যে তার ওপর ছড়ি ঘুরানোর ক্ষমতা আপনার নাই?
সে আপনার কোটি কোটি টাকার ধার ধারেনা। তার ওপর অত্যাচার নির্যাতনের জবাব সে কড়ায় গণ্ডায় দিতে জানে। তারে আপনি ঠ্যাকাবেন কি করে?”
জান্নাতুন নয়িম প্রীতি ৩০.০৩.২০
হবে কি হবে না জানি না। কী আছে সামনের দিনে জানি না। ক্ষুব্ধ কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য প্যারাসাইট ছবি দেখে প্রশ্ন তুলেছেন,
কে বেশি বিপজ্জনক ভাইরাস না দারিদ্র?
কে বেশি বিপজ্জনক, প্যারাসাইট না সাবওয়ের নীচে থাকা মানুষের গায়ের গন্ধ?
আসলে কারা পরজীবী? কারা ভাইরাস? কারা সংক্রমণের কারণ?
আমাদের বাড়িটা ভাঙে না। প্রত্যেকের বাড়ির ভিতরে এই গুপ্ত কুঠুরীতে লুকিয়ে আছে কেউ না কেউ। আমরা যাদের কাছে পরজীবী। আমরাই, এই পৃথিবীর জঘন্যতম ভাইরাস।
কবির ক্ষোভ দরিদ্রের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা যা ঘটছে গত কয়েকদিন ধরে। আমি তাঁর কথা শুনে মৃত্যু সংবাদ পেলাম নিউইয়র্ক নিবাসী এককালের ঢাকা টেলিভিশনের প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী লুতফুন্নাহার লতার লেখায়। কী কষ্ট! বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি করোনার খবর নিতে। খবরিয়া খবর নেবেই।
নিউইয়র্ক নিবাসী এককালের প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী লুৎফুন্নাহার লতা লিখলেন এক শোকগাথা। লতার কত প্রিয়জন যে চলে গেলেন এই ঘাতকের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মির্জা ভাই, এত তাড়াতাড়ি বিদায়?
তাকে আমি ডাকি মির্জা ভাই বলে। আমার সিনিয়র অথবা জুনিয়র সেই খবর আমি জানি না। সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ঠিক এমন সম্বোধন থেকেই। মির্জা ভাই আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। তবে বন্ধু শব্দটায় যেমন গলাগলির একটা সম্পর্ক বুঝায় ওঁর সাথে আমর সম্পর্কটা ঠিক তা ছিল না। তাঁর সঙ্গে ছিল আমার দীর্ঘদিনের ভালো এক পেশাদারী, আন্তরিক আবার আত্মিক সম্পর্ক। হায়! এই “ছিল” শব্দটা লিখতেও বুকটা আবার কেঁপে উঠলো। সম্ভবত ২০০৯ সাল থেকে মির্জা ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। অসাধারণ অমায়িক, চৌকুস আর ভদ্র মানুষ বলতে যা বোঝায় মির্জা ভাই ছিলেন ঠিক তাই। আমি তাকে সম্বধোন করতাম ’মির্জা ভাই’ আর মির্জা ভাই আমাকে বলতেন ’বস’। তিনি কেন আমাকে বস বলতেন জানি না তবে তিনি অনেককেই ‘বস’ বলে সম্বধোন করতেন। এটাই ছিল তার স্টাইল। আহা! কত স্মৃতি তাকে নিয়ে? কোন স্মৃতিটা ছোব আর কোনটা ছোব না?? আমি তখন দেলওয়ারে উইলমিংটনে থাকি। আইটি জব করি। কিন্তু মনটা সারাক্ষণ পরে থাকে নিউইয়র্কের দিকে। প্রতি শুক্রবার সপ্তাহান্তে আমি দেলওয়ার থেকে নিউইয়র্ক চলে যেতাম। তখন মির্জা থাকতো ভার্জিনিয়াতে অথবা ওয়াশিংটন ডিসিতে। ঠিক মনে নেই। সেও নিউইয়র্ক যেত। কারণ নিউইয়র্কে তার এবং আমাদের আরেক বন্ধু আকতার ভাইয়ের একটা আইটি স্কুল ছিল। আমাকে দেলওয়ার থেকে মাঝপথ থেকে তারা প্রায়ই তুলে নিত। গাড়িতে উঠলেই মির্জা ভা্ই বলতো, “বস, আপনি ড্রাইভ করেন”। তারপর দেলওয়ার থেকে নিউইয়র্ক-এর সেই দীর্ঘ তিন ঘন্টার পথ। আর সেই পথ কত দ্রুত শেষ হয়ে যেত! সেই যাত্রাপথে থাকতো কত আড্ডা! কত গল্প! কত ভবিষ্যত পরিকল্পনা!
আমি বাংলাদেশে আসার সপ্তাহখানেক আগের কথা। হঠাৎ মির্জা ভাইয়ের কল।
”বস, একটা অনলাইন পত্রিকা করতে চাই। আপনার হেলপ দরকার।” আমি বললাম, “আপনি পত্রিকা বের করবেন আর আমি থাকবো না? দেশ থেকে ঘুরে আসি তারপর আপনার সাথে বসবো এই নিয়ে।” সেই ছিল শেষ কথা তার সাথে। আর কী বসা হল মির্জা?
এই কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশ থেকে খবর পেলাম মির্জা ভাই আর নেই। করোনায় তার প্রাণ দিতে হয়েছে। গত কিছুদিন ধরেই সে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এলমহার্স্ট হাসপাতালে ছিল। সে খবর আমার জানা ছিল। আমার আরেক বন্ধু পাভেল চৌধুরী নিউইয়র্ক থেকে জানিয়েছিল মির্জা ভাই আগের থেকে একটু ভালো। শুনে মনটা কিছুটা হলেও স্বস্থি পেয়েছিল। আজ শুনলাম সে আর নেই। একটা মানুষ এই পৃথিবী থেকে এত দ্রুত ’নেই’ হয়ে যেতে পারে তা আমি ভাবতেও পারি না। যে লোকটা দু সপ্তাহ আগেও অফিস করেছে বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করেছে। চোখে তার কত স্বপ্ন! শুনলাম ভাবিও নাকি করোনায়া আক্রান্ত! হায় নিষ্ঠুর নিয়তি। তার ফুটফুটে দুটো সন্তান আছে। খোদা তো সে খবরটা জানে, নাকি? পৃথিবী এত কঠিন কেন? এই কি আমাদের সাধের ঠুনকো ভালোবাসার জীবন?
মির্জা ভাই, আপনাকে বিদায় জানাই কীভাবে? “বস, এত তাড়াতাড়ি আমাদের কাছ থেকে আপনার চলে যেতেই হল?” কী অদ্ভুত! এখন আপনার আত্মার শান্তি কামনা করে এই লেখা লিখতে হচ্ছে আমাকে! হায়! পৃথিবীটা কত নিষ্ঠুর! আপনার ফুটফুটে দুটো সন্তানের দিকে আমি তাকাতে পারছি না। হ্যাঁ, এখন ভাবিই তাদের একমাত্র ভরসা। প্রাণপণে দোয়া করছি ভাবিও যেন খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেন।
কী দুঃসময়! কী দুঃসময়!! বিশাল এক মৃত্যু মিছিলে আমরা হাঁটছি। এর শেষ কোথায়? কেউ জানি না।
সবাই আমার এই বন্ধুটির আত্মার শান্তির জন্যে দোওয়া করবেন।
খবরিয়া জানাচ্ছেন,
ভোরে আমার ঘুম তো ভাঙেই, দূর থেকে আযানের সুর ভেসে আসে ঘুমের ভিতর। আমি মোবাইল ফোনে দেখি কে কেমন আছেন, অচেনা ওয়াহিদ জালাল আমার ঘুমের ভিতরে লিখে গেছেন,
আমরা কে কোথায় আছি কিংবা কোথায় যাব কেউ জানি না। এই পৃথিবীতে আমাদের কোথাও লুকানোর জায়গা আজও কেউ তৈরি করতে পারেনি, পারবেও না। আত্মসমর্পণ ছাড়া কোন উপায় নেই। আসুন একে অপরের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ্ তুমিই আমাদের মালিক।
ওয়াহিদ জালাল, ৩০.০৩ ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড
৩১শে মার্চ ভোরে কত পাখি কলকল করতে লাগল, আমি হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার সং অফ দ্য রিভার শুনছিলাম, আহা শুনতে শুনতে ফেসবুক খুলেছি। রাজু আলাউদ্দিন মশায়ের কান্নাই প্রায় মিশে গেল চৌরাশিয়ার বাঁশির সুরের ভিতর। সৃষ্টির অতল তল থেকে হাহাকার ধ্বনি উঠে এল।
রাজু আলাউদ্দিন, ঢাকা, ৩১.০৩.২০
ছবির মানুষটিকে পত্রিকা ও আলোকচিত্র জগতের অনেকেই চেনেন। অন্তত নব্বুই দশকের সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীদের কাছে তিনি পরিচিতি ছিলেন নিশ্চয়ই। ওই সময়ই তাকে বাংলাবাজার পত্রিকায় সহকর্মী হিসেবে পাই, পরে মানবজমিন-এও সে আমার সহকর্মী ছিল। চটপটে, আলাপী আর বন্ধুবৎসল ধরনের মানুষ ছিল আবদুল হাই স্বপন। খুব সম্ভবত ২০০০ সালের পর তিনি মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সাল থেকে আমি তার কোনো খোঁজই জানতাম না প্রবাসী হওয়ার কারণে। ২০১০ ফিরে আসারও বহু বছর পর, সম্ভবত ২০১৬/১৭ সালে তার সাথে হঠাৎ করে যোগাযোগ হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। সে-ই কীভাবে যেন আমার খোঁজ পেয়ে প্রথমে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় এবং পরে ফোনে আলাপ হয়। আমাকে দেখার ইচ্ছার কথা জানিয়ে আমেরিকায় যাওয়ার দাওয়াতও করেছিল। আমি কথা দিয়েছিলাম পরের বার গেলে যোগাযোগ হবে। আমি পরে দুবার গেলেও স্বপনের সাথে আর যোগযোগ হয়নি। আজ শুনলাম সে এখন যোগাযোগের সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছে। করোনার নির্বিচার শিকার হলো আমার একসময়ের সহকর্মী ও বন্ধু স্বপন। এই প্রথম এত কাছের এবং এত পরিচিত কেউ করোনার শিকার হলো। সত্যি জীবন কত অনিশ্চিত। স্বপন বয়সে আমার সমান কিংবা আমার চেয়ে দু-এক বছরের ছোটই হবে। আমি যে এখনও বেঁচে আছি – এটাই বিস্ময়। হে বন্ধু, বিদায় জানাবার কথা কখনো ভাবিনি। অপেক্ষায় ছিলাম তোমার আলিঙ্গনের। কিন্তু করোনা সেই আলিঙ্গন থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করলো অসময়ে।