কান চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১ এর ‘আঁ সার্তে রিগার্দ’ ক্যাটাগরির পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে গত রাতে। ফ্রান্সের কান শহরের পালে দো ফেস্টিভ্যাল ভবনের দেবুসি থিয়েটারে বাংলাদেশ সময় ১৬ জুলাই দিবাগত রাত ১২টায় বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এই বিভাগে বাংলাদেশসহ আরো ২০টি দেশের ২০টি চলচ্চিত্র অংশ নেয়। সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নিয়েছে রাশিয়ান নারী নির্মাতা কিরা কোভালেনকোর রাশিয়ান ড্রামা ‘আনক্লেনচিং দ্য ফিস্টস্’। এই বিভাগের সবচেয়ে দামি পুরস্কার এটি – ‘গ্রান্ড প্রাইজ’। এবারের কানে এই বিভাগে নারী পরিচালকদের যে জয়-জয়াকার দেখা গেল, পরিচালক কোভালেনকোর তাদেরই একজন।
সেরা চলচ্চিত্র : ‘আনক্লেনচিং দ্য ফিস্টস্’
পুরস্কৃত এই ছবিটির গল্প রাশিয়ান গ্রামের এক তরুণীকে ঘিরে। তরুণীটি তার নিজের পরিবারকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু এই পরিবারেই একসময় তার দমবন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি দেখা দেয়। পরিবার থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই করতে শুরু করে সে। তার স্বাধীন হয়ে ওঠার দুর্দমনীয় দুঃসহ গল্পই এই চলচ্চিত্রের গল্প। তবে নিস্তরঙ্গভাবে নয়, ভায়োলেন্সের পটভূমিতে এক নারীর স্বাধীন হয়ে ওঠার কাহিনি।
‘আঁ সার্তেঁ রিগার্দ’-এর অর্থ হলো ‘ভিন্ন দৃষ্টিকোণ’। প্রচলিত ধারার বাইরের গল্পের সিনেমাগুলো এই বিভাগে নির্বাচিত হয়। এটি কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিশিয়াল সিলেকশনের একটি বিভাগ। এই ক্যাটাগরি চালু হয় ১৯৭৮ সালে। ২০০৫ সাল থেকে এই বিভাগে যিনি বিজয়ী হন, তাকে দেয়া হয় ৩০ হাজার ইউরো – বাংলাদেশি টাকায় ৩১ লাখ টাকা। এই বিভাগের এই সেরা পুরস্কারটি ছাড়াও আরও কয়েকটি পুরস্কার দেয়া হয়। সেগুলি হচ্ছে : জুরি প্রাইজ, এনসেম্বল প্রাইজ, প্রাইজ অব কারেজ, প্রাইজ অব অরিজিনালিটি, স্পেশাল মেনশন শীর্ষক পুরস্কার।
প্রতিবছর সারাবিশ্ব থেকে জমা পড়া চলচ্চিত্রগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করে নির্বাচিত প্রায় ২০টি চলচ্চিত্র নিয়ে আঁ সার্তেঁ রিগার্দ বিভাগটির আয়োজন করা হয় সেল ডেবুসি থিয়েটারে। বিচারকরা এই প্রতি বছর এই ২০টি ফিচার ছবির মধ্য থেকে বেছে নেন একটি সেরা ছবিকে। এবার বিচারকদের সভাপতি হিসেবে ছিলেন ব্রিটিশ নির্মাতা অ্যান্দ্রেয়া আর্নল্ড। অন্যান্যরা হলেন মার্কিন নির্মাতা মাইকেল কোভিনো, ফরাসি অভিনেতা এলসা জিলবারস্টেইন। আর্জেন্টিনার নির্মাতা ড্যানিয়েল বারম্যান এবং আলজেরিয়ান নির্মাতা মউনিয়া মেডৌর।
এবারের আঁ সার্তেঁ রিগার্দে বিজয়ী ছয় জনের চারজনই নারী। এর মধ্যে ফরাসি অভিনেত্রী-নির্মাতা আফসিয়া আর্জির ‘গুড মাদার’ ছবিটি সম্মিলিত অভিনয়ের পুরস্কার জিতেছে। স্পেশাল মেনশন পেয়েছে মেক্সিকোর তাতিয়ানা হয়েসো পরিচালিত ‘প্রেয়ারস ফর দ্য স্টোলেন’। প্রাইজ ফর কারেজ পেয়েছে রোমানিয়ার তেওদোরা আনা মিহাই পরিচালিত প্রথম ছবি ‘লা সিভিল’। আইসল্যান্ডের ভালদিমার ইওহানসনের প্রথম ছবি ‘ল্যাম্ব’ জিতেছে প্রাইজ ফর অরিজিনালিটির সম্মান। জুরি প্রাইজ পেয়েছে অস্ট্রিয়ার সেবাস্টিয়ান মায়েসের ‘গ্রেট ফ্রিডম’। পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কান উৎসবের পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমো। শুরুতে আঁ সার্তেঁ রিগার্দে নির্বাচিত ২০টি ছবির অংশবিশেষ দেখানো হয়। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ছিলো ‘রেহানা মরিয়ম নূর’।
নারী চলচ্চিত্র পরিচালকদের জয়-জয়াকার
পুরস্কৃত চলচ্চিত্রের কথা
জুরি প্রাইজ : গ্রেট ফ্রিডম (সেবাস্টিয়ান মাইজে)
গ্রেট ফ্রিডম হল অস্ট্রিয়ান চলচ্চিত্র। ছবিটি পরিচালনা করেছেন সেবাস্তিয়ান মাইস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জার্মানির একজন মানুষ সমকামী হওয়ার কারণে কারাগারে বন্দী হয় আর তার সেলমেট ভিক্টরের সাথে সম্পর্ক বিকাশের কাহিনি নিয়েই চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন হ্যান্সের ভূমিকায় ফ্রান্সজ রোগোভস্কি, ভিক্টর চরিত্রে জর্জি ফ্রেডরিচ, লিওর চরিত্রে অ্যান্টন ভন লুক্কে এবং ওসকার চরিত্রে থমাস প্রেন।
এনসেম্বল প্রাইজ : বোন মের/গুড মাদার (হাফসিয়া হারজি)
ফরাসি অভিনেত্রী, লেখক ও নির্মাতা হাফসিয়া হের্জি ‘গুড মাদার’ সিনেমায় তুলে ধরেছেন কিশোর অপরাধের কাহিনি। একটি গ্যাস স্টেশনে ডাকাতির পর নোরার ছেলে ধরা পড়ে। পঞ্চাশোর্ধ্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মী নোরা ছেলেকে মুক্ত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকেন। এই গল্পের আড়ালে অপেক্ষা করে আছে এক ভয়ঙ্কর কাহিনি। হাফসিয়া হেরজির পরিচালনায় নোরার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন হালিমা বেনহামেদ। ২০১৯ সালে প্রথম সিনেমা বানিয়েই হাফসিয়া হারজি কানের অফিশিয়াল সিলেকশনে জায়গা করে নেন।
প্রাইজ অব কারেজ : লা সিভিল (টেওডোরা আনা মিহাই)
বেলজিয়াম, মেক্সিকো ও রোমানিয়ার অর্থায়নে নির্মিত সিনেমা ‘লা সিভিল’। স্প্যানিশ ভাষার এই সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন টেওডোরা আনা মিহাই। এটি মেক্সিকোর একটি শহরের মা-মেয়ের গল্প। টিনএজ মেয়েটিকে একদিন অপহরণ করা হয়। মা সিলিয়ো তার মেয়েকে খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে ওঠেন। অভিনয় করেছেন আর্সিলিয়া রামরেজ, আলভারো গেরেরো, হোর্হে এ জিমনেজ প্রমুখ।
প্রাইজ অব অরিজিনালিটি : ল্যাম্ব (ভ্লাদিমির জোহানসন)
এ সিনেমার গল্পের নিঃসন্তান দম্পতি মারিয়া ও ইংভার। তারা আইসল্যান্ডের একটি খামারে এক নবজাতককে পান। এরপর শিশুটিকে নিয়ে শুরু হয় অপ্রত্যাশিত ঘটনা। এই ছবিটি পরিচালনা করেছেন আইসল্যান্ডের তরুণ নির্মাতা ভ্লাদিমির জনসন। এটি তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। তিনি এর আগে ‘হারমাসাগা’ নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়েছিলেন। মারিয়া চরিত্রে নুমি রাপাসে এবং ইংভার চরিত্রে হিলমির স্নায়ের গুডনাসন অভিনয় করেছেন।
স্পেশাল মেনশন : প্রেয়ার ফর দ্যা স্টোলেন (তাতিয়ানা উয়েজো)
এই মেক্সিকান চলচ্চিত্রটি গড়ে উঠেছে তিন কিশোরীকে কেন্দ্র করে। তাদের দিয়ে বলা হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা শহর আর যুদ্ধাস্ত্রের ভয়াবহতা। এতে অভিনয় করেছেন রিটা চরিত্রে মায়রা বাটাল্লা, লুজ হিসাবে নর্মা পাবলো ও জুলমা চরিত্রে অলিভিয়া লেগুনাস। ছবিটি পরিচালনা করেছেন তাতিয়ানা উয়েজো।
কান উৎসব ও ‘রেহানা মরিয়ম নূর’
এবারের কান উৎসবে এই বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে বাংলাদেশের সিনেমা ‘রেহেনা মরিয়ম নূর’ও । চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন। কোনো পুরস্কার না পেলেও চলচ্চিত্রটি উপস্থিত চলচ্চিত্র বোদ্ধা ও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কান উৎসবে অফিশিয়াল সিলেকশন হিসেবে এটিই প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র। সাদের কৃতিত্ব তাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী তার সিনেমাটি প্রদর্শিত হবে। তার সূত্রেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হলো বিশ্বচলচ্চিত্রের রথিমহারথিদের। প্রযোজকদের। ভবিষ্যতে তার নির্মিত ছবিতে অর্থায়নের সমস্যাও হয়তো মিটবে, এমনটা ধারণা করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমরা অনেক আশাবাদী হতে পারি।
যারা এই লেখাটা সম্পর্কে মন্তব্য করতে চান তারা নিচের Teerandaz Antorjal-এ ক্লিক করুন